ইমাম খাইর, সিবিএন:
বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট (বোরি) বা সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটকে অস্থিতিশীল করতে এবং বর্তমান সরকারকে বিপাকে ফেলতে নানামুখী ষড়যন্ত্র শুরু করেছে চিহ্নিত কুচক্রীমহল।

ওশনোগ্রাফি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়া হলেও এর বিরোধিতা করে কর্মসূচি দেওয়া হচ্ছে।

শুধু বোরির পরিবেশ অস্থিতিশীল করার চক্রান্তে মেতেছে স্বৈরাচারের দোসর একটি চক্র। কর্মবিরতির মতো প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মসূচিতে যাওয়ার হুঁশিয়ারিও দিয়েছে তারা।

গুরুত্বপূর্ণ এই প্রতিষ্ঠানটির স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত করে সরকারকে চাপে ফেলতে চায় দুষ্কৃতিকারী চক্রটি।

বিগত সরকারের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সহযোগিতায় এসব কর্মকাণ্ড করা হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

কল্যাণমূলক ও দুর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্রগঠনের লক্ষ্যে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নানামুখী সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। সেই ধারাবাহিকতায় অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ থাকা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের পরিবর্তন করছে সরকার। দেশের একমাত্র সমুদ্রবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান কক্সবাজারের বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট (বোরি) বা সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউট সংস্কারের লক্ষ্যে গত ৭ অক্টোবর মহাপরিচালক পদে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর হাইড্রোগ্রাফি ও ওশনোগ্রাফি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তা কমডোর এম মিনারুল হককে নিয়োগ দেওয়া হয়; কিন্তু বিগত সরকারের মদদপুষ্ট কিছু ব্যক্তি এ সংস্কারের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে ইনস্টিটিউটকে অস্থিতিশীল করতে এবং বর্তমান সরকারকে বিপাকে ফেলতে নানামুখী কর্মসূচি নিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, মিনারুল হককে নিয়োগ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারির খবর প্রকাশ হলে এর প্রতিবাদ জানান প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মরত বিগত সরকারের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। একই সঙ্গে গবেষণা প্রতিষ্ঠানটিতে শীর্ষ কর্মকর্তা পদে সংশ্লিষ্ট গবেষককে নিয়োগ দেওয়া, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদোন্নতি ও পেনশন সুবিধা দেওয়ার দাবি তোলা হয়েছে। দাবি আদায় না হলে কর্মবিরতির মতো কর্মসূচিতে যাওয়ারও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তারা। গত ৯ অক্টোবর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের মাধ্যমে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে পাঠানো এক স্মারকলিপিতে এসব দাবি তুলে ধরেন তারা।

জানা গেছে, সমুদ্র ও সমুদ্র সম্পদের সুরক্ষা এবং সমুদ্র জরিপ ও গবেষণায় বাংলাদেশ নৌবাহিনী পথিকৃৎ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে। সমুদ্রসীমার নিরাপত্তা বিধানের সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্র গবেষণায় গুরুত্বারোপ করে ১৯৮৩ সাল থেকে হাইড্রোগ্রাফি ডিপার্টমেন্ট এবং পরবর্তী সময়ে ব্লু-ইকোনমি সেল সংযোজন করে বাহিনীটি। বাংলাদেশ নৌবাহিনী হাইড্রোগ্রাফিক অ্যান্ড ওশনোগ্রফিক সেন্টারের (বিএনএইচওসি) অধীনে পরিচালিত সমুদ্র বিজ্ঞান গবেষণা ও হাইড্রোগ্রাফিক সার্ভে কার্যক্রমের মান আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনে সক্ষম হয়েছে। তাদের তৈরি করা পেপার ও ডিজিটাল নেভিগেশনাল চার্ট ব্রিটিশ অ্যাডমিরালটি কর্তৃক স্বীকৃত, যা বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অন্যান্য সামুদ্রিক জাহাজ ব্যবহার করছে। সমুদ্র অর্থনীতি বাস্তবায়ন এবং পানির গভীরতা পর্যবেক্ষণসহ সমুদ্র তলদেশের নানা প্রতিবন্ধকতা শনাক্ত করে সব জাহাজ চলাচলালের লক্ষ্যে নিরাপদ সমুদ্রপথ বজায় রাখতে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করছে বাহিনীটি। সেইসঙ্গে তাদের পাঁচটি রিসার্চ শিপ ও কিছু বিশেষায়িত সার্ভে বোট সমুদ্র গবেষণায় এরই মধ্যে সাফল্য দেখিয়েছে। বর্ণিত এসব গবেষণা কার্যক্রমে কমডোর মিনারুল হক সরাসরি জড়িত ছিলেন বলে তথ্য পাওয়া যায়।

বোরির নবনিযুক্ত মহাপরিচালক কমডোর এম মিনারুল হক নেভাল হাইড্রোগ্রাফি স্কুল, গোয়া, ভারত থেকে আইএইচও হাইড্রোগ্রাফি কোর্স এবং গোয়া ইউনিভার্সিটি থেকে হাইড্রোগ্রাফিতে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন। এ ছাড়া ভারতের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ওশোনোগ্রাফি থেকে ব্যবহারিক ও তাত্ত্বিক প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তিনি বর্তমানে ওশনোগ্রাফি নিয়ে পিএইচডি করছেন বলে জানা গেছে। এ ছাড়া বেসিক ও লং হাইড্রোগ্রাফিক কোর্সেও ওশানোগ্রাফি বিষয়ে অধ্যয়ন করেন। তিনি বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে ডাইরেক্টর অব হাইড্রোগ্রাফি, ডাইরেক্টর অব-ব্লু-ইকোনমি এবং বাংলাদেশ নৌবাহিনীর হাইড্রোগ্রাফিক ও ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ সেন্টারের অধিনায়ক হিসেবে সফলভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

বাংলাদেশের অন্যতম ‘ওশান রিসোর্স পারসন’ হিসেবে পরিচিত কমডোর মিনারুল হক বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব মেরিটাইম রিসার্চ অ্যান্ড ডেভলপমেন্টের (বিমরাড) মহাপরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগের আগে মেরিটাইম ইউনিভার্সিটিতে আর্থ ও ওশান সায়েন্স ফ্যাকাল্টির ডিন এবং ওশানোগ্রাফি ডিপার্টমেন্টের হেড হিসেবে কর্মরত ছিলেন, যেখানে তিনি ওশানোগ্রাফি বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করেছেন। এ ছাড়া তিনি ইউনিভার্সিটির ইনস্টিটিউট অব বে অব বেঙ্গল অ্যান্ড বাংলাদেশ স্টাডিজের ডিরেক্টর হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। কমডোর মিনারুল হক প্রায় ৩০ বছর ধরে হাইড্রোগ্রাফি ও ওশানোগ্রাফি বিষয়ক কর্মকাণ্ডসহ সমুদ্র গবেষণা কার্যক্রমে নিয়োজিত রয়েছেন। এমন একজন ব্যক্তিকে বোরিতে নিয়োগ দেওয়ার বিরোধিতা করায় বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

জানা গেছে, বিগত সরকারের আস্থাভাজন হয়ে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ পান ড. তৌহিদা রশীদ। তিনি বিগত সরকারের আমলে বিভিন্ন প্রকল্পের ক্রয় ও ঠিকাদার নির্বাচনে দলীয়করণ ও দুর্নীতিতে জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় বিগত সরকারের সুবিধাভোগী কিছু ব্যক্তি বর্তমান মহাপরিচালক নিয়োগে অসন্তুষ্ট হয়ে অপপ্রচারে লিপ্ত হয়েছে বলে জানা গেছে। বর্তমান সরকার দুর্নীতিবাজ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্রধান পরিবর্তনের মাধ্যমে বিগত দিনের নৈরাজ্য রোধের চেষ্টা অব্যাহত রাখায় বোরির কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী এই নিয়োগে বিরোধিতা করছেন বলে অভিযোগ। বিগত সময়ে মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করা বেশিরভাগ ব্যক্তিই সরাসরি ওশানোগ্রাফিতে বিশেষজ্ঞ ছিলেন না বলে জানা গেছে। এমনকি সদ্য সাবেক মহাপরিচালক ছিলেন একজন আবহাওয়াবিদ। বিগত সময় এ ধরনের ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়া হলেও এসব কর্মকর্তা-কর্মচারী বিরোধিতা করেননি। কিন্তু সরাসরি ওশনোগ্রাফি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ একজনকে মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার পরও এর বিরোধিতা করে কর্মসূচিতে যাওয়ার মতো বিষয়কে সন্দেহজনক কর্মকাণ্ড বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।